ঢাকা, ২৪ নভেম্বর:
শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতির পরও বাংলাদেশের
সীমান্তে হত্যা বন্ধ করেনি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিএসএফ। বরং গত বছরের তুলনায় সীমান্তে হত্যা বেড়েছে। ২০১২ সালের অক্টোবর
পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা হত্যা করেছে ৩৩ বাংলাদেশিকে। নতুন এই তথ্য প্রকাশ করেছে
বাংলাদেশের মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংস্থা ‘অধিকার’।
অধিকারের এই জরিপ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ‘জাতীয় সভায়’ যোগ দেওয়া রাজনীতিকরা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত
হয়ে বলছেন, হত্যা বন্ধ না হলে দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট
কাটবে না বরং ধীরে ধীরে বাড়বে। এই ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে দেন-দরবারে সব বাংলাদেশের সকল সরকারই ব্যর্থ হয়েছে
বলে মনে করেন রাজনীতিকরা। তাদের আশা রাজনৈতিক ঐক্যমত।
সভার শুরুতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে
নির্যাতিত বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান হাবু তার ওপর
নির্যাতনের দৃশ্য বর্ণনা করেন। হাবু বলেন, “ওরা আমাকে উলঙ্গ করে, তারপর বাঁশের সঙ্গে দু’হাত বেধে ফেলে। অনেকটা ক্রুশের মতো
করে বাঁধে। এরপর লাঠি দিয়ে পেটায়। আমার শরীরে তারা পেট্রোল ঢেলে দেয়।”
হাবু বলেন, “ওরা মারতে মারতে আমার আধমরা করে ফেলে। তারপর আমাকে সরিষা ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দেয়। ওরা ভাবে আমি মরে
গেছি।”
প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন বিএসএফ-এর
হাতে নিহত আরেক বাংলাদেশি সানাউল হকের ভগ্নিপতি। এরপরই সভায় যোগ দেওয়া
অতিথি এবং বাম দল ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “বাংলাদেশ এখনও বিশ্বাস করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে। কিন্তু এরকম ভাবে সীমান্তে
বিএসএফ হত্যা অব্যাহত রাখলে সেই সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে।”
সভায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পক্ষে
দলটির ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “ক’দিন আগে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া
ভারত সফর করেছেন। তখনও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এবং এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সীমান্তে
হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই প্রতিফলন নেই
বরং উল্টো আরও একটি সীমান্ত হত্যার খবর পাওয়া গেছে।”
শমসের মবিন বলেন, “এভাবে হত্যা চলতে থাকলে দুই দেশের মধ্যের অনাস্থা আরও বাড়বে। আস্থার সংকট মেটাতে
প্রয়োজন এই ধরনের সমস্যাগুলো মেটানো।”
চাইনবাবগঞ্জের হাবিবুর রহমান হাবুকে নগ্নাবস্থায়
পেটানোর উদাহরণ দিয়ে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সেক্রেটারী বলেন, “ঘটনাগুলো নিয়মিত ঘটছে।”
তিনি হাবুর কথা টেনে বলেন, হাবুকে পিটিয়ে সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর
সদস্যরা পৈচাশিক আনন্দ পায়। তবে পররবর্তীতে সেই ভিডিওচিত্রটি ভারতীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে পৌছে যায় দুনিয়ার
মানুষের কাছে। ভয়াল সেই দৃশ্য এখনও গায়ে কাঁটা দেয় মানুষের। নিজের মুখে সেই নারকীয়
ঘটনার বর্ণনা দিলেন হাবু। তার কথায় স্পষ্ট হলো, ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে
যত প্রতিশ্রুতিই আসুক, ব্যাক্তিগত স্বার্থহানী
হলে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা নির্যাতন বন্ধ করবে না।”
সভার বিষয় ‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা এবং বিএসএফ-এর মানবাধিকার লঙ্ঘন’। অতিথিরাও স্বীকার
করে নেন, স্বাধীনতার পরে যারাই সরকারে গড়েছে কেউই ‘সীমান্ত হত্যা’ ইস্যুতে সফল হয়নি। বিএনপি নেতা শমসের মবিন
চৌধুরী বলেন, “কথাটি মিথ্যা নয়। বাংলাদেশে যে সরকারই এসেছে
তাদের আমলেই ভারতের বিএসএফ-এর হত্যা অব্যাহত রয়েছে।”
অধিকারের তরফ থেকে আদিলুর রহমান জানান, “এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিএসএফ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সে সময়ও হত্যাকান্ড
কমেনি বরং আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি ছিলো।”
রাশেদ খান মেনন বলেন, “কোন সরকারই তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্ত করে গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষ করে যখন যে
সরকার এসেছে তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পররাষ্ট্রনীতি গড়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি
যে, তাদের বাইরে যে দলগুলো আছে তারাও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কিছু
জানতে পারে।”
সীমান্তে হত্যা বন্ধের প্রশ্নে শুধু সরকার নয় বরং
সর্বদলীয় ঐক্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন রাশেদ খান মেনন। সেক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি
জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের ভিত্তিকে করার তাগিদ তাদের।
উল্লেখ্য, অধিকারের প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, কিশোরী ফালানি,
কৃষক দুরুল হুদা কিংবা ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানের ওপর
নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটা করে সামনে এলেও ২০০০ থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত
বিএসএফ হত্যা করেছে ৯৬৬ বাংলাদেশিকে।
২০১১ সালে বিএসএফ হত্যা করেছিলো ৩১ বাংলাদেশিকে আর এবছর
অর্থাৎ ২০১২ সালের অক্টোবর
পর্যন্ত বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে।
পান্থ রহমান, ঢাকা